হুয়াস সফাল যালালু, লা ইয়াছবুতু আলাইহি ইল্লা আকদামুল উলামা
‘(সঙ্গীত⸺)এ এক পিচ্ছিল পাথর; কেবল উলামাদের পা-ই এর ওপর অবিচল থাকে।’
—সিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দি রহ.
.
শুরুটা যেভাবে
………………..
ঘরে বসে পড়তে পারছি না। পাশের বাসা থেকে আসছে বিকট ভলিউমে মিউজিকের শব্দ। কান-মাথা ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।
বাইরে হাঁটতে গেলে কানে তুলা ঢুকিয়ে নিলেই ভালো হয়; যদি-না ভয় থাকে রিক্সার বেল বা গাড়ির হর্ন শুনতে না পেয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার।
চায়ের দোকানে একটু বসবেন, সুযোগ নেই; ওখানেও আছে মিউজিক। আছে টিভি। উলঙ্গ উত্তঙ্গ মিউজিকের সঙ্গে কারও সুর ভাজার আয়োজনও মিলতে পারে আপনার জন্যে। আছে এমনই চারপাশে। ঘরে-বাইরে, বিক্রির দোকানপাটে, চলন্ত পথঘাটে। মিউজিক থেকে যেন নিস্তার নেই এই পৃথিবীর। মিউজিক ছাড়া কি পৃথিবী সত্যিই অচল?
গাবতলির গাড়িতে বসে আছি। আমার পাশের সিটে যে ছেলেটি বসে আছে, জিগেশ করলাম, ভাই, কোথায় যাবেন? আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘সরি, ভাই, কিছু বলছেন? শুনতে পাই নি!’
কী করে শুনবেন তিনি? কানে তো হেডফোন।
ক-দিন আগেই তো, এই আমাদের প্রিয় দেশ, বাংলাদেশে মিউজিক নিয়ে হত্যাকাণ্ডও সঙ্ঘটিত হলো। প্রশ্ন জাগে মনে, প্রিয় বাংলাদেশ, মিউজিক ছাড়া অচল তুমি?!
নাশতার টেবিলের সমঘন দুধের মতো মিডিয়াযন্ত্র তার বিশাল ফাঁদে (শুধু মুসলিমই নয়) সারা বিশ্বের যুবকদের সংস্কৃতিতে সমমাত্রায় ঘনিভূত করে ফেলেছে। বিশ্বের যুবকরা জানে না, সঙ্গীত তার শ্রবণশক্তি, স্নায়ুশক্তি, শরীর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আত্মার কী ক্ষতি করে চলেছে। মিউজিকের প্রভাব তার কলবের ওপর কী করে চলেছে। সে এটুকুই শুধু জানে, এ এক দারুণ মজা। অমৃত। কাজের শক্তি। স্পৃহা। আর পপ সংস্কৃতির এটাই সর্বোচ্চ লক্ষ্য।
ইসলামের নামে-বেনামে ক্রমবর্ধমান সঙ্গীতের এই জোয়ারে ভেসে যাওয়ার উপক্রম আমাদের এই মুসলিমসমাজের ক্রান্তিকালে কে উদ্ধার করবে তাদের? কে এর স্বরূপ বোঝাবেন? কে নেবেন এই গুরুদায়িত্ব? আমার মনে এই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অনেক খুঁজেও বাংলা ভাষায় ভালো, নিদেনপক্ষে প্রয়োজন পূরণ করে⸺এমন কোনো বই খুঁজে ফিরছিল; কিন্তু প্রাপ্তির মুখ দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। এমন সময় একটি বই পেলাম মাকতাবাতুল ফুরকানের সৌজন্যে। ‘পিচ্ছিল পাথর’। সত্যি বলতে, বইটি হাতে নিয়ে আমার প্রথম ভাবনা ছিল, এই বই এত দিন কোথায় ছিল? আমি কেন দেখি নি বইটি এত দিন? হৃদয় আমার প্রশান্ত করে দিয়েছিল সেদিন পিচ্ছিল পাথর। বলি কি, তোমার খুব প্রয়োজন ছিল আমার, আগ বেড়ে বলি, শুধু আমার না, সময়ের মুসলিম উম্মাহর। পিচ্ছিল পাথরের মতো এমন একটি বই খুবই প্রয়োজন ছিল বাংলা ভাষায়। আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দান করুন লেখক-প্রকাশক-অনুবাদককে। আমিন।
.
বই সম্পর্কে
…………….
লেখকের ভূমিকা থেকে জানা যায়, বইটি রচনা করতে গিয়ে তিনি পাঁচ-পাঁচটি বছর ব্যয় করেছেন। বার বার একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারপর চূড়ান্ত কপি তৈরি করেছেন। সৈয়দ সালমান নদভি এই বইটির প্রশংসায় লিখেছেন, ‘বইটি ইংরেজি সাহিত্যে এক অমূল্য সংযোজন। আলোচ্য বিষয়ের ওপর লেখক তার সমস্ত গবেষণা একত্র করতে গিয়ে কঠিন পরিশ্রম করেছেন। শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্যই নয়; বরং আরবি, উরদু এবং ইংরেজিতে প্রাপ্ত সমসাময়িক বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করে সে বিষয়ে যে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, তা অবশ্যই কৃতিত্ব ও প্রশংসার দাবিদার।’ এই মূল্যবান অভিমতের পাশে ছোট্ট করে বলা যায়, এই বইটি বাংলা সাহিত্যের বিরাট এক শূন্যতার অনেকাংশ⸺বলতে গেলে পুরোটাই⸺পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে; কারণ, এই বইটি পড়ার পর মিউজিক সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির আর কিছু জানতে বাকি থাকবে বলে মনে হয় না!
.
লেখক সম্পর্কে
……………….
খালেদ বেগ। ইসলাম এবং সমসাময়িক বিষয়ে বিশিষ্ট গবেষক, লেখক। আমেরিকার ক্যালেফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত ‘আল-বালাগ’ ই-জার্নালের সম্পাদক। তার বিখ্যাত অনুবাদগ্রন্থ The Accepted Whispers এর বাংলা অনুবাদ ‘মুনাজাতে মকবুল’ ছাপা হলে বাংলাদেশে তিনি ভালো পরিচিতি পান। বর্তমানে উলামায়ে কেরাম পাশ্চাত্য ইসলামি স্কলারদের মধ্যে তার বইপত্রই একটু বেশি পছন্দ করেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত হাদিসবিশারদ মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবও তার লিখিত বইপত্র পড়ার পরামর্শ দেন।
.
বিষয়বস্তুর ফিরিস্তি
……………………
‘পিচ্ছিল পাথরে’ মূল তিনটি পরিচ্ছেদের অধীনে বারটি অধ্যয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচিত হয়েছে মিউজিকের আদি-অন্ত। ইসলামে কাব্যচর্চা দিয়ে শুরু করে একেএকে ইসলামের আগে-পরে সঙ্গীত, সঙ্গীত ও মিডিয়া বিপ্লব, সঙ্গীত বিষয়ে প্রাচ্যবিশারদদের বিভিন্ন প্রসঙ্গ, কুরআন-হাদিসের দলিল, সঙ্গীত সম্পর্কে প্রথম যুগের মুসলিমদের অভিমত, সামা, সূফিদের অভিমত, মালাহি প্রসঙ্গে আলোচনা, সঙ্গীতের ব্যাপারে বিভিন্ন মাজহাবের ফকিহদের মতামতসহ আধুনিক মুসলিমসমাজে সঙ্গীদের প্রভাব, লাইস আল-ফারুকির শব্দকলার ক্রমধারা, নাশিদ, কুরআন তিলাওয়াত এবং সঙ্গীত ছাড়াও আওলোচিত হয়েছে সঙ্গীতের নানান বিষয়।
পুরো বইটি একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য অবশ্যই বিশাল কিছু; পরম আকাঙ্ক্ষিত; বইটি পড়তে পড়তে শেষ দিকে গিয়ে আমার কাছে শেষ অংশ আরও আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। সেখানে পরিশিষ্ট শিরোনামে পুরো বইয়ে আলোচিত প্রায় সত্তরজন মনীষীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে। নির্ঘণ্ট থেকে পাওয়া যাবে বইয়ের আলোচিত বিভিন্ন পরিভাষা ও শব্দের পরিচিতি। ইসলামি বইয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটির অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মাকতাবাতুল ফুরকানকে ধন্যবাদ।
বিশাল কলেবরের এই বইটি মাত্র ২৪০ টাকায় পাঠকের করমলে তুলে দিচ্ছে মাকতাবাতুল ফুরকান। কালারড কাগজ এবং পেপারব্যাক বাঁধাইয়ে ভালোই লেগেছে বইটি। অনেক দিন আগে কিনে এসে রেখেছিলাম। পড়বো, পড়বো, শেষ করবো করবো করেও করতে পারি না। রিভিউ প্রতিযোগিতার সুবাদে সুযোগটুকু পেয়ে গেলাম, আলহামদু লিল্লাহ।
ভিন্ন দেখায়
……………
এত বড় বইটি পরের সংস্করণ হার্ডকভারে আরও মানাবে মনে হয়। এক-দুটি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে। উল্লেখযোগ্য নয় বলেই মনে করি; তবুও প্রকাশক চাইলে পরের মুদ্রণে ঠিক করে নেবেন, বিশেষত শুরুতে পরিচ্ছদ এবং পরিচ্ছেদ-এর শুদ্ধ বানান ও পার্থক্যটা; এবং সেটি আরও ভালো হবে বলে মনে করি।
প্রাসঙ্গিক তথ্য :
………………….
বই : পিচ্ছিল পাথর
লেখক : খালেদ বেগ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আদম আলী
প্রকাশক : মাকতাবাতুল ফুরকান
পৃষ্ঠাসংখ্যা :৪০০
বাঁধাই : পেপারব্যাক
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ (৫০% ছাড়)